আজ মঙ্গলবার, ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

দফায়-দফায় বাড়ে দাম আম জনতার ঝরে ঘাম

মোহাম্মদ নেয়ামত উল্লাহ:
দফায় দফায়, কারণে-অকারণে বাড়ে চালের দাম। চালের মূল্য নির্ধারণে তো বটেই চালের বাজারের উপর সরকারের যেন কোন নিয়ন্ত্রণ নাই। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র সরকারের ‘বাজার সি-িকেটকে’ তোষণ ও পোষণের কারণে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণহীণ হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, চালের চাহিদা, মজুদ ও উৎপাদন নিয়ে সঠিক তথ্য না থাকায় এক্ষেত্রে একধরণের ‘হুজুগে’ ব্যাপার ‘নিয়ন্ত্রকের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) সরকারি-বেসরকারি একাধিক সংস্থার তথ্যমতে, দেশে দৈনিক জনপ্রতি ৫৬২ গ্রাম চালের চাহিদা রয়েছে। সে হিসাবে দেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য প্রতিদিনের চালের চাহিদা ৮৯ হাজার ৯২০ টন বা ৯০ হাজার টন। ওই হিসাবে এক মাসে চালের প্রয়োজন হয় ২৭ লাখ টন। বছরে খাদ্যের চাহিদা দুই কোটি ৯৩ লাখ (চাল ও গম) মেট্রিক টন। উৎপাদন হচ্ছে তিন কোটি ৮ লাখ মেট্রিক টন। তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন বেশি খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে। সে হিসাবে খাদ্য রপ্তানি করার কথা। কিন্তু রপ্তানি না হয়ে বছরে প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য আমদানি হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চাল আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন; একই সময়ে গম আমদানি হয়েছে ৩৭ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৫ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন; এবং গম আমদানি হয়েছে ২৭ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সঠিক জনসংখ্যা, দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন ও খাদ্যের চাহিদা নিরূপণের ত্রুটি রয়েছে এ জন্য খাদ্য পরিস্থিতির সঠিক চিত্রটি উঠে আসছে না। আর এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী, রাজনীতি ও আমলাদের নিয়ে গঠিত সিন্ডিকেট।
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, খাদ্য রপ্তানী তো দূরে থাক, খোদ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া আমদানীর তথ্য দেখলেই বিষয়টি বেশ পরিস্কার হয়ে উঠে। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ২২ অক্টোবর ২০১৭ আপডেট দেয়া দেয়া তথ্যে দেখানো হয়েছে-এ বছরের ২ মে থেকে শুরু হয়ে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২,৮০,৭৯৫ মেট্রিক টন বোরো চাল (সিদ্ধ ও আতপ) এবং ৪,৭০২ মেট্রিক টন ধান সর্বমোট চালের আকারে ২,৮৩,৮৫২ মেট্রিক টন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। একইভাবে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে মজুদ পরিস্থিতি দেখানো হয়েছে- খাদ্যশস্যের মোট মজুদ ৪.৯৯ লাখ মেঃ টন। এর মধ্যে চাল ৩.৯৬ লাখ মেঃ টন এবং গম ১.০৩ লাখ মেঃ টন। এছাড়া বন্দরে ভাসমান অবস্থায় ০.৯০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। ওই সময়ের মধ্যে সরকারী পর্যায়ে চাল ও গম মিলিয়ে আমদানী করে ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৫২০ মেট্রিক টন, ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন চাল, বাকিটা গম। কিন্তু বেসরকারীভাবে একইসময়ে ২৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৯০ মেট্রিক টন চাল ও গম আমদানী হয়। এরমধ্যে চাল ৯ লাখ ৪১ হাজার ৩৩০ মেট্রিক টন চাল। ১৯ লাখ ২ হাজার ৪৬০ মেট্রিক টন গম। যদিও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত একমাত্র সংস্থা খাদ্য অধিদপ্তরের ১৯.৫০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশষ্য ধারণ করার ক্ষমতা রয়েছে। এ দপ্তরের অধীনে দেশে ৫টি সাইলো, ১৩টি সিএসডি এবং ৬৩১টি এলএসডি আছে।

সঠিক তথ্য পরিসংখ্যান ও নিয়ন্ত্রণহীণতার কারণে চালের দাম বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের দেয়া তথ্যে, গত ১১ বছরে চালের দাম প্রায় আড়াইগুণ বেড়েছে। ক্যাবের দেয়া তথ্যে ২০০৬ সালে মিনিকেট চালের খুচরা বাজার মূল্য ছিল ২৭ টাকা ৯৫ পয়সা, যা ২৪ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে ৭০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। একইভাবে ২০০৬ সালে নাজিরশাইলের দাম ছিল ২৫ টাকা ৫৪ পয়সা, পাইজাম চালের দাম ছিল ২৩ টাকা, পারিজা/স্বর্ণার দাম ছিল ১৯ টাকা ২৫ পয়সা, বিআর এগারো/আটের দাম ছিল ১৮ টাকা ২৫ পয়সা।
যদিও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যের বরাত দিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ২৪ অক্টোবর ২০১৭ সর্বশেষ আপডেটে লেখা ছিল-ঢাকার বাজারে (ক) মোটা চালের পাইকারী মূল্য প্রতি কেজি ৪১.০০-৪২.০০ টাকা, মোটা চালের খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ৪৩.০০-৪৫.০০ টাকা, (খ) আটার (খোলা) খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ২৭.০০- ৩০.০০ টাকা।
চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের তথ্যে অনেক ঘাটতি রয়েছে। যার কারণে কখনও কখনও খেসারত দিতে হয় দেশের প্রায় ১৮ হাজার চালকল মালিকদের। ২০১৩ সালে চাল মজুদের অভিযোগে ১৬ হাজার মিলকে ‘কালে’ তালিকাভুক্ত করা হয়। তাদের কাছ থেকে চাল না কেনার সিদ্ধান্ত হয় সে বছর।
তাদের দাবি, খাদ্যশষ্যের উৎপাদন, মজুদ ও আমদানী নিয়ে দেয়া সরকারের বক্তব্য অনেকটাই রাজনৈতিক। প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত্ব ও পরিসংখ্যান ছাড়াই এসব বক্তব্য জনগণকে ধোকা দেয়া সামিল। সম্প্রতি চাল ব্যবসয়ীদের গুদামে তল্লাশী ও আটক করার প্রসঙ্গ টেনে দেশের কয়েকজন শীর্ষ চাল ব্যবসায়ী বলেন, আমরা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম, কিন্তু সরকার তার জবাব দিতে পারেনি। উদাহরণ হিসেবে কয়েকজন চালকল মালিক বলেন, ওয়েবসাইটে ২০১৩ সালের উৎপাদনের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের ২০টি দেশের তালিকায় বিশ্বের দশম বৃহত্তম খাদ্য উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা বাংলাদেশকে। ওই তালিকায় শীর্ষে ছিল চীন। কিন্তু বাস্তবতায় সে বছরও খাদ্য আমদানী করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে; যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টন। অথচ দেশের চাহিদা ২ কোটি ৯৩ লাখ মেট্রিক টন।

২০১১ সালের ২০ অক্টোবর ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০১০’ প্রকাশ করে জাতিসঙ্ঘ জনসংখ্যা তহবিল। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৪ লাখ ২৫ হাজার। অথচ তারও এক বছর পরে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত ২০১১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনা রিপোর্টে বলা হয়, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের চাল সঙ্কটের মূলে এমন গোলমেলে আদমশুমারি।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জনসংখ্যার সঠিক সংখ্যা পরিসংখ্যানে উঠে না আসায় দেশের চালের চাহিদা নির্ধারণও সঠিকভাবে হচ্ছে না। একইভাবে চালের উৎপাদন এবং চাহিদা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও রয়েছে গোলমাল। ফলস্বরূপ প্রায় প্রতি বছরই চালকেন্দ্রিক নানা সঙ্কটের সৃষ্টি হচ্ছে। উপযুক্ত দাম না পেয়ে এক বছর কৃষক হতাশ হচ্ছেন, অন্য বছর অধিক দামে চাল কিনতে গিয়ে পকেট কাটছে ক্রেতার।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের হাতেও পর্যাপ্ত চালের মজুদ নেই। স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ লাখ টন চাল কম নিয়ে ২০১৭ সাল শুরু করেছেন তারা।
অভিযোগ রয়েছে, চাল সঙ্কট নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করলেও ‘রহস্যজনক কারণে’ এখনো সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কঠোরতা আরোপ করতে পারছে না সরকার। ঘাটতি মেটাতে এ বছর ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে সরকার থেকে সরকার (জিটুজি) পদ্ধতিতে এ চাল কিনতে চান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য টনপ্রতি ৪৭০ ডলার দাম অনুমোদন করেছে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। অথচ এরই মধ্যে প্রতি টন চাল ৪০৬ দশমিক ৪৮ ডলার দরে সরবরাহ করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক মেসার্স অ্যাগ্রোক্রপ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, চলতি অর্থবছরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ১৫ লাখ টন চাল কেনার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে তাতে কম করে হলেও ৭৮৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতি হবে। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনায় বসে দরকষাকষি করা হলে এ দর আরো নিচে নেমে আসবে। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের সদিচ্ছাই চালের এ সঙ্কট দূর করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে বাস্তবভিত্তিক পরিসংখ্যান তৈরি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় না দিয়ে সরকারীভাবে সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা করা দরকার। প্রয়োজনে খাদ্য অধিদপ্তরকে আধুনিকায়ন করে এর মাধ্যমে সুষ্ঠ বণ্টন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যেতে পারে।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ